ক্রাইম প্রতিবেদক: নগরীর প্রবেশমুখ রাস্তার মাথা এলাকায় কথিত শ্রমিক নেতা নামধারী একদল দুবৃত্তের চাঁদাবাজি ও নির্যাতনের ফলে অস্থির হয়ে পড়েছে সিএনজি চালক-মালিক ও স্থানীয়রা। রাস্তার মাথায় পরিবহন সেক্ঠরের অন্যতম চাঁদাবাজ মোহাম্মদ আবুল হোসেনের নেতৃত্বে এসব অপকর্ম চলছে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছে একাধিক সিএনজি চালক।
চালকেরা জানান, তার রয়েছে প্রায় ৭০ জনের একটি সন্ত্রাসী বাহিনী ও একটি টর্চার সেল। সিএনজি চালকরা নিয়মিত চাঁদা না দিলে ওই বাহিনীর সদস্যরা টর্চার সেলে নিয়ে অমানসিক নির্যাতন চালায়। এসব ব্যপারে সংশ্লিষ্ট থানা ও আদালতে ডজন খানেক মামলা থাকলেও রহস্যজনক কারনে নিরবতা পালন করছে স্থানীয় বিট, থানা ও ট্রাফিক পুলিশ প্রশাসন। বিশাল এই বাহিনীর খরচ মেটাতে পরিবহনে চাঁদাবাজির পাশাপাশি করছেন চুরি ছিনতাই ও মাদকের ব্যবসাও প্রয়োজনে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। আর এসব অপকর্মের অর্জিত আয়ের একটা অংশ সরকার বিরোধী কাজেও ব্যয় করছেন বলে জানা গেছে। তবে মাঝে মাঝে র্যাবের জোড়ালো ভুমিকার ফলে গা ঢাকা দিলেও পরে আবার নির্বিঘ্নে চালায় অপকর্ম।
যে কারনে অত্যাচার:
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চালকেরা দি ক্রাইমকে জানায়, রাউজান রাঙ্গুনীয়া ও হাটহাজারী রুটে প্রায় ৫ হাজার সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করে। আর এসব গাড়িগুলো রাস্তার মাথা হইতে যাত্রী ওাঠা-নামা করায় এখানে চাঁদাবাজির মেইন পয়েন্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি গ্রামের নাম্বার সংবলিত সিএনজিকে মাসিক ৫৫০ টাকা এবং নাম্বার বিহীন সিএনজিকে ৮০০ টাকা দিয়ে টোকেন নিতে বাধ্য করে মো. আবুল হোসেনের চট্টগ্রাম অটোরিক্সা অটো টেম্পু চালক সমন্বয় পরিষদের ব্যানারে কাপ্তাই রাস্তার মাথা পরিচালনা কমিটি নামক সিন্ডিকেটটি। এছাড়াও প্রতিটি সিএনজি যাত্রী তোলার সময় দিতে হয় ১০ টাকা করে এভাবে সিএনজি প্রতি গড়ে একশ থেকে দেড়শ টাকা চাঁদাবাজি করে যার পরিমান দাঁড়ায় দৈনিক প্রায় ৬ লাখ টাকা যা মাসে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ।
এসব চাঁদা আদায়ের জন্য তার রয়েছে প্রায় ৭০ জনের একটি নিজস্ব বাহিনী দৈনিক ৪ শিফটে সকাল ৬টা থেকে রাতের ১২ টা পর্যন্ত সিএনজি থেকে টাকা তোলার জন্য প্রতি শিফটে রয়েছে ১৫ জন করে ৬০ জনের গ্রুপ এর বাইরে তাদের দেখভালের জন্য রয়েছে আরো একটি স্পেশাল গ্রুপ। যদি কোন চালক চাঁদা দিতে অস্বীকার বা গড়িমসি করে তাহলে তাকে ( চালক) ধরে নিয়ে যায় পার্শ্ববর্তী রেলের জায়গা দখল করে বানানো টর্র্চার সেলে। সেখানে নিয়ে চলে মারধর ও অমানুসিক শাররীক নির্যাতন। এমনকি গাড়ি আটক করে মালিক থেকে আদায় করা হয় মোটা অংকের চাঁদা।
অপর একটি সুত্র দি ক্রাইমকে জানায়, চাঁদা তোলার দায়িত্বে যারা আছে তাদের ডিউটি দৈনিক ৬ ঘন্টা হওয়ায় বাকী সময়টা তারা চুরি ছিনতাই মাদক সেবন ও পাচারের কাজে ব্যয় করে। স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রহস্যজনক কারনে অনেক সময় দেখেওে না দেখার ভান করে চলে যায়। যা একান্তই ধামচাপা দেওয়ার মত নয় সেগুলোই কেবল মামলা হিসেবে এন্ট্রি করে । আবার অনেক সময় থানায় মামলা না নেওয়ার অভিযোগও করেন অনেকে। ফলে আদালতে সিআর মামলা দায়ের করতে বাধ্য হয়েছেন বিবাদীরা।
কারা আছেন সিন্ডিকেটে ?
বর্তমানে কথিত শ্রমিক নেতা জাহেদ, হাসান,আজাদ, ভুট্রো হাওলাদার, রাসেল, মানিক,জাফর, সাহেদ,রানা,শাহেদ আলী ও রাশেদুল ইসলাম এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য।
যেভাবে উত্থান আবুল হোসেনের:
রাঙ্গুনীয়া উপজেলার মরিয়ম নগরের কুমার পাড়ার এক দরিদ্র ঘরে জন্ম কথিত এই শ্রমিক নেতা আবুল হোসেনের। বিগত ২০১১ সালেও রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। যুদ্ধাপরাধের মামলায় ফাঁসি হওয়া সালাউদ্দিন কাদেরের আস্থাভাজন এনডিপি নেতা আলতাফ প্রকাশ কানা আলতাফের সাথে ছিল সখ্যতা। অভাব অনটনে চলতে না পেরে ২০১২ সালে আসেন শহরে। সিএন্ডবি এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থেকে সিএনজি চালাতো ২০১৩ সালে আজাদ নামের একজনের অধীনে।
রাস্তার মাথা এলাকায় সিএনজির লাইনম্যানের কাজ করার পাশাপাশি ফুটপাত থেকে চাঁদাও তুলতেন। একই বছরের শেষের দিকে চট্টগ্রাম অটোরিকশা অটোটেম্পু শ্রমিক ইউনিয়নের (১৪৮৭)এর সদস্য হন। ২০১৪ সালে পরিবহন সেক্টরের আর এক চাঁদাবাজ শ্রমিক নেতা হারুন উর রশিদের সাথে মিলে চট্টগ্রাম অটোরিকশা অটোটেম্পু শ্রমিক ইউনিয়নের (১৪৪১)এর সদস্য হন। সেই থেকে তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
মো. আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা:
কথিত এই শ্রমিক নেতার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সিআর মামলা নং ১৫৮/১৭,১২৬/১৭, ৫৬১/১৭, এবং চান্দগাঁও থানার মামলা নং-২৬ তারিখ ১৬/১০/২০, মামলা নং- ৯ তারিখ ৬/১০/১৮ মামলা নং-২৪ তারিখ ১৮/৫/১৬, মামলা নং-২ তারিখ ১/১০/১৮ ও মামলা নং-৩৮ তারিখ ২৯/১১/১৮ চলমান রয়েছে।
কোথায় যায় এতো টাকা:
তার দলের সদস্য ছাড়াও এই টাকার ভাগ পেয়ে থাকেন স্থানীয় থানা বিট ও ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। এছাড়া কিছু পাতি নেতাও পায় ভাগের একটি অংশ। সবাইকে দিয়ে নিজে হয়েছেন অঢেল সম্পদের মালিক। তার গ্রামের বাড়ি রাঙ্গুনীয়ায় গড়ে তুলেছেন আলিশান ভবন। বোয়ালখালী পৌরসভা এলাকায় কিনেছেন জমি, ভবন নির্মানের কাজ চলমান আছে। স্থানীয় বিএনপি নেতা আবু সুফিয়ানের সাথে রয়েছে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ২০১৮ সালের নির্বাচনে অনেক টাকা খরচ করেছেন বলেও গোপন সুত্রটি জানিয়েছে।
বিএনপির দলীয় কার্যক্রমে ব্যয় করেছেন বিপুল অর্থ যার একটা অংশ সরকার বিরোধী কাজেও লাগিয়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে লাগিয়েছেন পোস্টার। যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছবি দিয়ে ছাপানো পোস্টারে নিজেকে রাঙ্গুনীয়া উপজেলা ছাত্রদলের নেতা প্রমান করতে চেষ্টা করেন। তবে বর্তমানে তিনি চান্দগাঁও থানা যুবদলের নেতা দাবী করছেন।
মো. আবুল হোসেনের বক্তব্য:
শ্রমিক নির্যাতনের বিষয়টি অস্বীকার করলেও সিএনজি থেকে চাঁদাবাজির কথা স্বীকার করে মো. আবুল হোসেন বলেন, আমরা আমাদের সদস্যদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে থাকি চাঁদার জন্য কারো উপর নির্যাতন করিনা। টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতনের একটি ভিডিও প্রতিবেদকের হাতে আছে জানালে তিনি বলেন, আমাদের যেসব চালক নেশা করে তাদেরকে সেখানে শাসন করা হয়। ১০/১২ টি মামলা থাকার কথা স্বীকার করে বলেন এগুলো পার্টিগত মামলা।
আমি জামিনে আছি। জমি ও নতুন ভবন নির্মানের বিষয়টি স্বীকার করলেও পুলিশকে কোন মাসোহারা দেয়নি এবংং বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত নয় বলে জানান তিনি। তবে মাঝে মাঝে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে পুলিশ অভিযান চালালে ২/৩ ঘন্টা বন্ধ থাকলেও সারা বছরই অবৈধ সিএনজি স্টেশনের বেপরোয়া চাঁদাবাজি চলে আসছে।
পুলিশের বক্তব্য:
এব্যপারে জানতে চান্দগাঁও থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি)কে মোবাইলে কল দিলে রিসিভ করেও কথা বলেননি। পরে আবারো কল ও বার্তা দিয়েও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।
Post Views: 213