মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : আগামী ১ ফেব্রুয়ারি থেকে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ৬০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাইলটিং অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর জন্য বইও ছাপা হচ্ছে। এই পাইলটিং শেষে ২০২৩ সালে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম অনুযায়ী প্রাথমিকে দ্বিতীয় এবং মাধ্যমিকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি শিক্ষাক্রম চালু করা হবে, ২০২৪ সালে প্রাথমিকের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে চালু করা হবে, ২০২৫ সালে প্রাথমিকে পঞ্চম এবং মাধ্যমিকে নবম ও দশম শ্রেণিতে বাস্তবায়ন করা হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই উদ্যোগ কতখানি সফল হবে তা নির্ভর করবে পাইলটিং ফলাফল শেষে শ্রেণিভিত্তিক নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠিত হওয়ার পর। সরকারের পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে মহৎ, কিন্তু এত অল্প সময়ে এর যথাযথ প্রয়োগ ঘটানো কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সংশয়মুক্ত হওয়া বেশ কঠিন। কেন না নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষা নয়, শিখনফল এবং বাস্তব জ্ঞান অর্জনে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা অনেকটাই নির্ভর করছে শিক্ষকদের দক্ষতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের নতুন শিক্ষাক্রম বুঝতে পারার সক্ষমতার ওপর।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিকই একমাত্র প্রতিষ্ঠান নয়। এখানে বিভিন্ন ধারা, উপধারার মাদ্রাসা শিক্ষা যেমন রয়েছে, ব্যক্তিমালিকানাধীন এবং বেসরকারি বিভিন্ন মানের ও মাধ্যমের কেজি স্কুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও রয়েছে। সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শিক্ষার গুণগত মানের মধ্যে ব্যাপক তারতম্য রয়েছে। মাদ্রাসাগুলোর প্রতিষ্ঠা, অনুমোদন, পরিচালনা এবং লেখাপড়ার তদারকিতে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এগুলোর শিক্ষাক্রমও সরকারের শিক্ষানীতি নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রণয়ন, নিয়ন্ত্রণ কিংবা পরিচালিত হচ্ছে না। ব্যক্তি মালিকানাধীন এবং বেসরকারি বিভিন্ন ধরন ও শিক্ষার মাধ্যম একইভাবে এনসিটিবি প্রণীত শিক্ষাক্রম, পাঠ্যবই এবং নীতি পরিকল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। নানা ধরনের বৃত্তিমূলক কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেড়ে উঠলেও এগুলোর বেশিরভাগই মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে এখনো সমাজে স্থান করে নিতে পারেনি। ফলে দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক এবং সমমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মানের কোনো ন্যূনতম বিধিবিধান কার্যকর হয়ে আসেনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নামে নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা হলেও এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদনে সরকারি শিক্ষা অধিদপ্তর তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পেরেছে বলে মনে হয়নি। এর ফলে ব্যাঙের ছাতার মতো নানা ধরনের, মানের এবং উদ্দেশ্য সাধনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শহরের আনাচে-কানাচে এবং গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে উঠেছে। সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নতুন করে খুব একটা বেড়েছে বলে মনে হয় না। তবে বিভিন্ন ধরনের মাদ্রাসার বিস্তার অপরিকল্পিতভাবে ঘটে চলছে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, পাঠদান, শিক্ষাক্রম, বই পুস্তক, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা খুব একটা বিধিবদ্ধভাবে পরিচালিত হয় না।
অসংখ্য শিক্ষার্থী এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে কতটা মানসম্মত শিক্ষা, ভাষা দক্ষতা, জ্ঞান দক্ষতা এবং চিন্তার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয় সেটি বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কেউ তদারক করার নেই। আলিয়া মাদ্রাসাগুলো মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে হওয়ায় সেগুলোতে বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ কিছুটা হলেও রয়েছে। অন্য ধারার মাদ্রাসাগুলো স্বতন্ত্র শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পুরোপুরিভাবে নেই। ফলে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জন মানসম্মত হওয়ার বাধ্য বাধকতা ও বিধিবিধান মানা হচ্ছে না, দেখার কোনো কার্যকর সংস্থার উপস্থিতিও নেই। ফলে বাংলাদেশে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বিভিন্ন ধারার ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও মানসম্মত শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্যকর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। কেজি স্কুল ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যেও নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ মানার প্রবণতা।
বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও মানসম্মত পঠনপাঠনের অনুকূল পরিবেশ সমানভাবে তৈরি করতে পারছে না। যদিও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাক্রম, পরীক্ষা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ইত্যাদি দেখভাল করে থাকে। কিন্তু সেখানেও মানের তারতম্য দূরীকরণের কার্যকর চেষ্টা খুব একটা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। শহরাঞ্চলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও বড় ধরনের তারতম্য দৃশ্যমান। গুটিকয়েক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পেছনে অভিভাবকদের সন্তান ভর্তি করার ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার মূলে এলাকা ও স্থানীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার পরিবেশ, মান নিয়ে গুরুতর অভিযোগ এবং অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। এটি খুবই দুঃখজনক যে শহরাঞ্চলেও মানসম্মত শিক্ষালাভের পরিবেশ বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিরাজ করছে না। গ্রামাঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ সবসময়ই ওঠানামার মধ্যে থাকে। সুতরাং দেশে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ বিরাজ করছে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দুর্ভাগ্যজনকভাবে মোটেও উল্লেখ করার মতো নয়। অথচ শিক্ষার পেছনে সরকার যেমন অর্থ ব্যয় করে, অভিভাবকরাও সন্তানদের শিক্ষার পেছনে এখন অর্থ ব্যয়ে যথাসম্ভব চেষ্টা করে থাকে। দরিদ্র পরিবারের অভিভাবকরা হয়তো সন্তানদের পেছনে বাড়তি অর্থ খরচ করতে পারছে না তবে ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সরকার বিনামূল্যে পাঠ্যবই স্কুল এবং আলিয়া মাদ্রাসায় প্রদানের ব্যবস্থা করার পর গরিব অভিভাবকদের সন্তানদের শিক্ষার ব্যয় হ্রাস পেয়েছে। একইভাবে উপবৃত্তির সংখ্যাও গরিব এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে শিক্ষায় সরকারের বিনিয়োগ ক্রমবর্ধমান হারে বাড়লেও শিক্ষার মান আশানুরূপভাবে বাড়ছে না। এর মৌলিক দুর্বলতা বেশ অতীত থেকেই চলে আসছে। তবে অতীতে শিক্ষায় সরকারের বরাদ্দ এবং সুযোগ-সুবিধা খুবই সীমিত ছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
অতীতে দারিদ্র্যের হারও ছিল অনেক বেশি। সে কারণে শিক্ষার সুযোগ ছিল খুবই সীমিত পর্যায়ে। সরকার যখন থেকে শিক্ষায় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে থাকে তখন থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দ্রুত বেড়ে যেতে থাকে। শিক্ষার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে নানা ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি এবং নিয়োগের নামে চাকরি দানের প্রবণতা। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে খুব বেশি কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি। তাছাড়া দেশে সত্যিকার অর্থে কোনো আধুনিক মানবসম্পদ নীতি প্রণীত ও বাস্তবায়িত করার উদ্যোগও দৃঢ়ভাবে কোনো সরকার নেয়নি। এর ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার নামে বাংলাদেশে যা কিছু গড়ে উঠেছে তার সঙ্গে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সম্পর্ক ক্রমেই ক্ষীণ হতে থাকে। বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই গড়পড়তা মানের নিচে নেমে যেতে থাকে। কিছুসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নামিদামি হিসেবে খ্যাতি অর্জনের মাধ্যমে ভর্তি বাণিজ্য, শিক্ষকদের বেশিরভাগই কোচিং বাণিজ্য এবং শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারী বাণিজ্যের পথে হাটে। সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মূলত উচ্চবিত্তের সন্তানদেরই পড়ার সুযোগ ঘটে থাকে। নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের পরিবারের সন্তানদের জন্য মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে এখন নিম্নগামিতার মুখে পড়েছে। সেগুলোতেও এখন কোচিং অবধারিতভাবে বহাল রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণিপাঠ ক্রমেই আকর্ষণ হারিয়ে ফেলছে। শিক্ষকদের মধ্যেও শ্রেণিপাঠদানের দায়িত্ববোধ অনেকটাই আকালে পড়েছে। সে কারণেই শিক্ষার ব্যয় অভিভাবক পর্যায়ে এখন ক্রমেই বেড়ে চলছে। কিন্তু সন্তানকে মানসম্মত শিক্ষা দেয়ার সুযোগ অর্থ খরচ করেও আশানুরূপভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। এখানে নীতি-নৈতিকতার সংকট বেড়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। এটি দেশ এবং জাতির জন্য খুবই উদ্বেগের, অশনি সংকটেরও বটে।
আমাদের দেশে এখন প্রায় সব কিছুর শিক্ষার্থী কোনো না কোনো মাধ্যমে পড়াশোনা করছে বলে আমরা জানি। কিন্তু অভিভাবকদের বিশেষ তত্ত্বাবধানে যেসব শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে তাদের বাইরে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী খুব বেশি সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারছে না। অনেক শিক্ষার্থীই ঝরে পড়ছে। আবার অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে যারা মানসম্মত শিক্ষালাভের ধারেকাছেও যেতে পারছে না। এদের বেশিরভাগই প্রতিষ্ঠান অতিক্রম করলেও কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য যেসব দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন তার অনেকই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে লাভ করতে পারেনি। ফলে এদের বড় একটি অংশই বেকারত্বের সীমাহীন জীবন সংকটে পড়ে। আমাদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষার কত শতাংশ শিক্ষার্থী মানসম্মত শিক্ষালাভে বঞ্চিত হয় সেই পরিসংখ্যান নির্ভরযোগ্য সংস্থা দ্বারা গ্রহণ করা হলে আমাদের হতাশ হওয়া ছাড়া উল্লসিত হওয়ার তেমন কিছু খুঁজে পাবে বলে আমার মনে হয় না। এটি সামগ্রিকভাবেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, অদূরদর্শিতা, বাণিজ্যমুখিতা এবং শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞতার ফলে এতটা তীব্রতর হয়েছে।
শিক্ষা ব্যবস্থার উপর্যুক্ত বাস্তবতা আমাদের এখন আর অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এটি আরো চলতে দেয়া হলে আমাদের বিশাল তরুণ সমাজ অদক্ষ, অযোগ্য, সৃষ্টিহীন, উদ্ভাবনহীন একটি জনগোষ্ঠী হিসেবেই থেকে যাবে। অথচ আমাদের সন্তানরা মোটেও মেধায় পিছিয়ে পড়ার নয় কিন্তু চিন্তার উন্মেষ, মেধা মননের বিকাশ ঘটানোর জন্য দেশে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কয়েক দশকে গড়ে উঠেছে তার বেশিরভাগই আধুনিক শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম এবং শিক্ষা ব্যবস্থাপনার ন্যূনতম শর্ত পূরণ করছে না। সে কারণে আমাদের শিক্ষার এমন বেহাল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং এখন যে উদ্যোগ শিক্ষা মন্ত্রণালয় গ্রহণ করতে যাচ্ছে তা সফল করার ক্ষেত্রে মৌলিক দুর্বলতাগুলোকে চিহ্নিতকরণ এবং দূরীকরণে বিশ্বজনীন শিক্ষা দর্শনের পথেই সমাধান খুঁজতে হবে। এলোমেলোভাবে এর সমাধান অর্জিত হওয়ার নয়। শিক্ষাব্যবস্থার সাংবিধানিক দায়িত্ব ও অধিকারকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। মানের এসব বিভক্তি এবং অসমতা কোনোভাবেই চলতে দেয়া উচিত নয়, সুতরাং শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে শিক্ষার গুণগত মানের সমতা বিধান গ্রাম ও শহরে করার কথাটি বিশেষভাবে মনে রেখেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় কাক্সিক্ষত সুফল লাভের সুযোগ তৈরি হবে।
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।
patwarimamtazuddin@gmail.com