মো. রুহুল আমীন: বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা গুলো সম্প্রতি নতুন করে অস্থির হয়ে উঠেছে। পার্বত্য জেলাগুলোতে একের পর এক হত্যাকাণ্ড চলছে। বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠির মধ্যে হত্যা এবং পাল্টা হত্যাকাণ্ড চলছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলার মধ্যে বেশি অস্থিরতা দেখা বান্দরবানে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে সেখানে ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করতে হচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার রাতে বান্দরবানে গোলাগুলিতে আট জনের মৃত্যু হয়েছে।কিন্তু হঠাৎ করে কেন পাহাড়ি এলাকা অস্থির হয়ে উঠছে? কুকি-চিন ঘিরে রহস্য বান্দরবানে সম্প্রতি সবচেয়ে আলোচিত হয়ে উঠেছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ। বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসাবে বর্ণনা করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা গুলোতে নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীরও ভূমিকা রয়েছে। আইএসপিআর জানিয়েছে, ‘’মূলত আঞ্চলিক সশস্ত্র দলগুলোর নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একের পর এক আত্মঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের এই আধিপত্য বিস্তারের অন্যতম মূল আগ্রহ হলো বিভিন্ন উৎস থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া।‘এটা করতে গিয়ে কখনো কখনো তাদের নিজেদের অন্তঃদ্বন্দ্বের বলি হচ্ছে সাধারণ জনগণ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা,‘ বলছে আই এস পি আর।

May be an image of 6 people

আইএসপিআর জানিয়েছে, স্থানীয় সূত্রে তারা জানতে পেরেছে যে, বান্দরবানে গত বৃহস্পতিবার যে আট নর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, সেটি কেএনএফ এবং ইউপিডিএফের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে ঘটেছে।”স্থানীয় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সমন্বয় করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে,” বলছে আইএসপিআর।

কেএনএফের ঘোষণা ও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যে দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির অন্তত ছয়টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তারা। যদিও দলবদ্ধভাবে তাদের বম নৃ-গোষ্ঠী হিসেবেও প্রচার করছে অনেকে। তাদের সামরিক শাখা কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি বা কেএনএফ।

পার্বত্য এলাকার পর্যবেক্ষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব) এমদাদুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’এই কুকি-চিনের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ পাওয়াটা এবং তাদের হঠাৎ করে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি এখন পর্যন্ত রহস্যজনক।‘’

পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির পেছনে কারণ বিশ্লেষন করে জানা যায়, ১৯৯৭ সালে যখন শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছিল, তখন পাহাড়ে অনেক ছোট ছোট গ্রুপ থাকলে ও কুকি-চিনের মতো গোষ্ঠীগুলো তখন ততোটা গুরুত্ব পায়নি। তাদের দাবি-দাওয়াও পরিষ্কার ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি অনেকটা হঠাৎ করেই কুকি-চিনের মতো গোষ্ঠীগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ এর নেতারা বলছেন, ‘’কোন দাবি-দাওয়া, আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়াই কুকি-চিন অস্ত্র হাতে প্রকাশ্যে চলে এলো। সেই সাথে জঙ্গিদের সাথেও তাদের একটি যোগাযোগ দেখা যাচ্ছে। তারা অস্ত্র পেয়েছে, প্রশিক্ষণ পেয়েছে। এগুলো জানার পরেই কুচি-চিনের বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে এসেছে।‘এই গোষ্ঠীর সদস্যদের রোয়াংছড়ি অঞ্চলে যেমন উপস্থিতি রয়েছে, তেমনি ভারতের মিজোরামেও তাদের উপস্থিতি আছে বলে জানা যায়। বান্দরবানে বা পাহাড়ি জেলাগুলোয় এরকম সংঘর্ষের ঘটনা এবারই প্রথম নয়।গত বছরের নভেম্বর মাসে তমব্রু সীমান্তে একটি সংঘর্ষের ঘটনায় স্কোয়াড্রন লিডার র‍্যাংকের একজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছিলেন, যিনি সামরিক প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তর বা ডিজিএফআইতে নিয়োজিত ছিলেন। সেই সময় পুলিশের বিশেষ বাহিনী র‍্যাবের একজন কর্মকর্তাও আহত হন।

গত বছরের মার্চ মাসে বান্দরবানের রুমা এলাকার গোলাগুলিতে চারজন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। এর আগের মাসেই সেনাবাহিনীর একটি টহল দলের ওপর ‘জেএসএসের হামলায়’ একজন সেনা সদস্যসহ ৪ জন নিহত হয়েছিল।সে বছরের অক্টোবর মাস থেকেই বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় জঙ্গি এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান শুরুর কথা জানিয়েছিল বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ। রুমা এবং রোয়াংছড়ি এলাকায় সেই বিশেষ অভিযান শুরু করায় হয়। সেই সময় ওই এলাকায় পর্যটকদের যাতায়াতও নিষিদ্ধ করা হয়, যা এখনো বলবত আছে। শুধু বান্দরবান নয়, গত কয়েক বছর ধরে রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়িতে এরকম একাধিক সংঘর্ষ এবং হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

যদিও বান্দরবানে তুলনামূলক সহিংসতার ঘটনা কম ঘটেছে, কিন্তু এই জেলার আশেপাশের এলাকাগুলো বরাবরই সহিংসতা প্রবণ। যেমন সীমান্তের ওপারেই রয়েছে আরাকান আর্মি, কাচিন বিদ্রোহীদের প্রবণতা, মিজোরামে ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ আশঙ্কা করছেন, তাদের কারণেও কুকি-চিন গোষ্ঠী প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারে। সর্বশেষ সংঘর্ষের ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক বাহিনী জড়িত রয়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের বরাত দিয়ে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের সাংবাদিকরা জানাচ্ছেন।

ভূ-রাজনীতি, চাঁদা ও আধিপত্যের দ্বন্দ্বঃ

পার্বত্য এলাকায় বিভিন্ন নামে যেসব গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, তাদের আদর্শিক দ্বন্দ্বের চেয়ে আধিপত্য বিস্তার এবং চাঁদার ভাগবাটোয়ারা প্রধান বিষয়। সে নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্যই প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।পার্বত্য চট্টগ্রামের জনৈক মানবাধিকার কর্মী বলছেন, ‘’আদর্শিক দ্বন্দ্ব তেমন কিছু নেই। মূল বিষয়টা হচ্ছে আধিপত্য বিস্তার এবং চাঁদাবাজি। আমি একটা হিসাবে দেখেছি, বিভিন্ন গ্রুপ মিলে বছরে সাতশো কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি করা হয়। এই অবারিত চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্যই বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটছে।‘’

May be an image of 5 people

তিনি বলছেন, ‘’পার্বত্য চট্টগ্রামকে অনেক সময় বিভিন্ন মহল থেকে একটা বাফার জোন হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে ভূ-রাজনৈতিক কারণে এই এলাকার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে বিভিন্ন মহল, বিভিন্ন দেশ সহায়তা করেছে।” গত কয়েক মাসে পার্বত্য জেলাগুলোয় একাধিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

‘’আমার মনে হচ্ছে, এই এলাকাটিতে অশান্ত রাখার জন্য- কোন কোন মহল, জাতীয় হোক আর আন্তর্জাতিক হোক- অস্থির করে তোলার একটা অপচেষ্টা করছে। ইদানীং বেশি সহিংস ঘটনা ঘটছে, অতীতেও যে ঘটেনি তা নয়, কিন্তু সেনাবাহিনীর কারণে তা অনেক কমে গিয়েছিল। সেটাকে যারা পছন্দ করছে না, তারা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।‘’ বিশ্লেষক এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মনে করছেন, অব্যাহত সহিংসতার কারণে পার্বত্য এলাকায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

সহিংসতার প্রভাব পড়ছে পাহাড়ি এলাকাগুলো ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন, কৃষিসহ প্রতিটি খাতে। এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে সে অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে পড়ার আশংকাও তৈরি হতে পারে। একই সাথে পর্যটন ব্যবসা কমে যাওয়া এবং সীমান্ত সড়কের যেসব কাজ চলমান ছিল, সেগুলোও স্থবির হয়ে যেতে পারে আশংকা করছেন অনেকে।

পাহাড়ে নানা পক্ষ, বহু গোষ্ঠীঃ

১৯৯৭ সালে যখন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংহতি সমিতির শান্তি চুক্তি হয়, তখন তার প্রকাশে বিরোধিতা করেছিল ইউপিডিএফ। সেই চুক্তির ফলে পাহাড়ি এলাকায় শান্তি ফিরলে কোন কোন পক্ষ সেই চুক্তির বাস্তবায়ন চায়নি বলে অনেক বিশ্লেষক বলছেন।এসব মহল কারা, সেটি তিনি পরিষ্কারভাবে বলতে চাননি।

‘’আমরা দেখতে পাচ্ছি, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি স্থাপিত হোক, একটা মহল সেটা মেনে নিতে পারছে না। তারা মনে করে, তাহলে তাদের যে আধিপত্য এখানে আছে, সেটা ক্ষুণ্ণ হবে। এজন্যই কেএনএফ সৃষ্টি করা হয়েছে, আজকে সেই কেএনএফ অশান্তির কারণ হয়েছে।

রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি বাংলাদেশের পার্বত্য তিন জেলাতেই পাহাড়ি বাঙালির ভূমি বিরোধ। ২০১৭ সালে ইউপিডিএফ ভেঙ্গে নতুন করে ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক নামে আরেকটি দল তৈরি হয়। অন্যদিকে জনসংহতি সমিতি ভেঙ্গে জেএসএস (এমএন লারমা) নামে আগেই আরেকটি দল তৈরি হয়েছিল।পাহাড়ি এলাকায় এই চারটি গোষ্ঠীর মধ্যে অব্যাহত সংঘাত লেগেই রয়েছে। গত পাঁচ বছরে এসব গোষ্ঠীর সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের নেতৃবৃন্দের অভিমত অবিলম্বে সরকারের উচিৎ অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টিকারী রাষ্টদ্রোহীদের দমনে যৌথ বাহিনীর অভিযান অব‍্যাহত রেখে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে জনগণের জানমাল ও রাষ্টীয় সার্বভৌমত্বের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

মো. রুহুল আমীন: বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা গুলো সম্প্রতি নতুন করে অস্থির হয়ে উঠেছে। পার্বত্য জেলাগুলোতে একের পর এক হত্যাকাণ্ড চলছে। বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠির মধ্যে হত্যা এবং পাল্টা হত্যাকাণ্ড চলছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলার মধ্যে বেশি অস্থিরতা দেখা বান্দরবানে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে সেখানে ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করতে হচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার রাতে বান্দরবানে গোলাগুলিতে আট জনের মৃত্যু হয়েছে।কিন্তু হঠাৎ করে কেন পাহাড়ি এলাকা অস্থির হয়ে উঠছে? কুকি-চিন ঘিরে রহস্য বান্দরবানে সম্প্রতি সবচেয়ে আলোচিত হয়ে উঠেছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ। বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসাবে বর্ণনা করছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা গুলোতে নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীরও ভূমিকা রয়েছে। আইএসপিআর জানিয়েছে, ‘’মূলত আঞ্চলিক সশস্ত্র দলগুলোর নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একের পর এক আত্মঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের এই আধিপত্য বিস্তারের অন্যতম মূল আগ্রহ হলো বিভিন্ন উৎস থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া।‘এটা করতে গিয়ে কখনো কখনো তাদের নিজেদের অন্তঃদ্বন্দ্বের বলি হচ্ছে সাধারণ জনগণ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা,‘ বলছে আই এস পি আর।

May be an image of 6 people

আইএসপিআর জানিয়েছে, স্থানীয় সূত্রে তারা জানতে পেরেছে যে, বান্দরবানে গত বৃহস্পতিবার যে আট নর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, সেটি কেএনএফ এবং ইউপিডিএফের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে ঘটেছে।”স্থানীয় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সমন্বয় করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে,” বলছে আইএসপিআর।

কেএনএফের ঘোষণা ও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের উদ্দেশ্যে দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির অন্তত ছয়টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তারা। যদিও দলবদ্ধভাবে তাদের বম নৃ-গোষ্ঠী হিসেবেও প্রচার করছে অনেকে। তাদের সামরিক শাখা কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি বা কেএনএফ।

পার্বত্য এলাকার পর্যবেক্ষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব) এমদাদুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’এই কুকি-চিনের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ পাওয়াটা এবং তাদের হঠাৎ করে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি এখন পর্যন্ত রহস্যজনক।‘’

পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির পেছনে কারণ বিশ্লেষন করে জানা যায়, ১৯৯৭ সালে যখন শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছিল, তখন পাহাড়ে অনেক ছোট ছোট গ্রুপ থাকলে ও কুকি-চিনের মতো গোষ্ঠীগুলো তখন ততোটা গুরুত্ব পায়নি। তাদের দাবি-দাওয়াও পরিষ্কার ছিল না। কিন্তু সম্প্রতি অনেকটা হঠাৎ করেই কুকি-চিনের মতো গোষ্ঠীগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ এর নেতারা বলছেন, ‘’কোন দাবি-দাওয়া, আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়াই কুকি-চিন অস্ত্র হাতে প্রকাশ্যে চলে এলো। সেই সাথে জঙ্গিদের সাথেও তাদের একটি যোগাযোগ দেখা যাচ্ছে। তারা অস্ত্র পেয়েছে, প্রশিক্ষণ পেয়েছে। এগুলো জানার পরেই কুচি-চিনের বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে এসেছে।‘এই গোষ্ঠীর সদস্যদের রোয়াংছড়ি অঞ্চলে যেমন উপস্থিতি রয়েছে, তেমনি ভারতের মিজোরামেও তাদের উপস্থিতি আছে বলে জানা যায়। বান্দরবানে বা পাহাড়ি জেলাগুলোয় এরকম সংঘর্ষের ঘটনা এবারই প্রথম নয়।গত বছরের নভেম্বর মাসে তমব্রু সীমান্তে একটি সংঘর্ষের ঘটনায় স্কোয়াড্রন লিডার র‍্যাংকের একজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছিলেন, যিনি সামরিক প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা পরিদপ্তর বা ডিজিএফআইতে নিয়োজিত ছিলেন। সেই সময় পুলিশের বিশেষ বাহিনী র‍্যাবের একজন কর্মকর্তাও আহত হন।

গত বছরের মার্চ মাসে বান্দরবানের রুমা এলাকার গোলাগুলিতে চারজন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। এর আগের মাসেই সেনাবাহিনীর একটি টহল দলের ওপর ‘জেএসএসের হামলায়’ একজন সেনা সদস্যসহ ৪ জন নিহত হয়েছিল।সে বছরের অক্টোবর মাস থেকেই বান্দরবানের দুর্গম এলাকায় জঙ্গি এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান শুরুর কথা জানিয়েছিল বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ। রুমা এবং রোয়াংছড়ি এলাকায় সেই বিশেষ অভিযান শুরু করায় হয়। সেই সময় ওই এলাকায় পর্যটকদের যাতায়াতও নিষিদ্ধ করা হয়, যা এখনো বলবত আছে। শুধু বান্দরবান নয়, গত কয়েক বছর ধরে রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়িতে এরকম একাধিক সংঘর্ষ এবং হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

যদিও বান্দরবানে তুলনামূলক সহিংসতার ঘটনা কম ঘটেছে, কিন্তু এই জেলার আশেপাশের এলাকাগুলো বরাবরই সহিংসতা প্রবণ। যেমন সীমান্তের ওপারেই রয়েছে আরাকান আর্মি, কাচিন বিদ্রোহীদের প্রবণতা, মিজোরামে ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা রয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ আশঙ্কা করছেন, তাদের কারণেও কুকি-চিন গোষ্ঠী প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারে। সর্বশেষ সংঘর্ষের ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক বাহিনী জড়িত রয়েছে বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের বরাত দিয়ে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের সাংবাদিকরা জানাচ্ছেন।

ভূ-রাজনীতি, চাঁদা ও আধিপত্যের দ্বন্দ্বঃ

পার্বত্য এলাকায় বিভিন্ন নামে যেসব গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, তাদের আদর্শিক দ্বন্দ্বের চেয়ে আধিপত্য বিস্তার এবং চাঁদার ভাগবাটোয়ারা প্রধান বিষয়। সে নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্যই প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।পার্বত্য চট্টগ্রামের জনৈক মানবাধিকার কর্মী বলছেন, ‘’আদর্শিক দ্বন্দ্ব তেমন কিছু নেই। মূল বিষয়টা হচ্ছে আধিপত্য বিস্তার এবং চাঁদাবাজি। আমি একটা হিসাবে দেখেছি, বিভিন্ন গ্রুপ মিলে বছরে সাতশো কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি করা হয়। এই অবারিত চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্যই বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটছে।‘’

May be an image of 5 people

তিনি বলছেন, ‘’পার্বত্য চট্টগ্রামকে অনেক সময় বিভিন্ন মহল থেকে একটা বাফার জোন হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। ফলে ভূ-রাজনৈতিক কারণে এই এলাকার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে বিভিন্ন মহল, বিভিন্ন দেশ সহায়তা করেছে।” গত কয়েক মাসে পার্বত্য জেলাগুলোয় একাধিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

‘’আমার মনে হচ্ছে, এই এলাকাটিতে অশান্ত রাখার জন্য- কোন কোন মহল, জাতীয় হোক আর আন্তর্জাতিক হোক- অস্থির করে তোলার একটা অপচেষ্টা করছে। ইদানীং বেশি সহিংস ঘটনা ঘটছে, অতীতেও যে ঘটেনি তা নয়, কিন্তু সেনাবাহিনীর কারণে তা অনেক কমে গিয়েছিল। সেটাকে যারা পছন্দ করছে না, তারা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।‘’ বিশ্লেষক এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মনে করছেন, অব্যাহত সহিংসতার কারণে পার্বত্য এলাকায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

সহিংসতার প্রভাব পড়ছে পাহাড়ি এলাকাগুলো ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন, কৃষিসহ প্রতিটি খাতে। এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে সে অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত হয়ে পড়ার আশংকাও তৈরি হতে পারে। একই সাথে পর্যটন ব্যবসা কমে যাওয়া এবং সীমান্ত সড়কের যেসব কাজ চলমান ছিল, সেগুলোও স্থবির হয়ে যেতে পারে আশংকা করছেন অনেকে।

পাহাড়ে নানা পক্ষ, বহু গোষ্ঠীঃ

১৯৯৭ সালে যখন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংহতি সমিতির শান্তি চুক্তি হয়, তখন তার প্রকাশে বিরোধিতা করেছিল ইউপিডিএফ। সেই চুক্তির ফলে পাহাড়ি এলাকায় শান্তি ফিরলে কোন কোন পক্ষ সেই চুক্তির বাস্তবায়ন চায়নি বলে অনেক বিশ্লেষক বলছেন।এসব মহল কারা, সেটি তিনি পরিষ্কারভাবে বলতে চাননি।

‘’আমরা দেখতে পাচ্ছি, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি স্থাপিত হোক, একটা মহল সেটা মেনে নিতে পারছে না। তারা মনে করে, তাহলে তাদের যে আধিপত্য এখানে আছে, সেটা ক্ষুণ্ণ হবে। এজন্যই কেএনএফ সৃষ্টি করা হয়েছে, আজকে সেই কেএনএফ অশান্তির কারণ হয়েছে।

রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি বাংলাদেশের পার্বত্য তিন জেলাতেই পাহাড়ি বাঙালির ভূমি বিরোধ। ২০১৭ সালে ইউপিডিএফ ভেঙ্গে নতুন করে ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক নামে আরেকটি দল তৈরি হয়। অন্যদিকে জনসংহতি সমিতি ভেঙ্গে জেএসএস (এমএন লারমা) নামে আগেই আরেকটি দল তৈরি হয়েছিল।পাহাড়ি এলাকায় এই চারটি গোষ্ঠীর মধ্যে অব্যাহত সংঘাত লেগেই রয়েছে। গত পাঁচ বছরে এসব গোষ্ঠীর সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের নেতৃবৃন্দের অভিমত অবিলম্বে সরকারের উচিৎ অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টিকারী রাষ্টদ্রোহীদের দমনে যৌথ বাহিনীর অভিযান অব‍্যাহত রেখে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে জনগণের জানমাল ও রাষ্টীয় সার্বভৌমত্বের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।