দি ক্রাইম ডেস্ক : বিশাল মাঠ জুড়ে সবুজ ঘাস। সারি সারি পাথর। নানা রঙের ফুলের সমাহার। পুরো মাঠই যেন একটি নান্দনিক ফুলের বাগান। চারপাশ গোছানো, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। দেখে বোঝার উপায় নেই, চট্টগ্রামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ব্রিটিশ মিত্রবাহিনীর যোদ্ধাদের সমাধিস্থল এটি। বড় আকারের সাদা ক্রুশ জানান দিচ্ছে সমাধিক্ষেত্রের পবিত্রতা। প্রতিটি সমাধির পাশে আছে ফুলের গাছ। কিছু গাছের ফুল ঝরে পড়েছে সমাধিতে। চট্টগ্রামের ওয়ার সিমেট্রি হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত এই সমাধিস্থল যেন এক খন্ড ভূস্বর্গ।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের (চমেক) দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে পাহাড়ি রাস্তার কিছুটা ঢালু আর কিছুটা সমতল ভূমিতে গড়ে উঠেছে এই সমাধি। সম্পূর্ণ সমাধি এলাকার পরিবেশ একই সাথে মনোরম, গুরুগম্ভীর ও শান্ত। সাত একর জায়গার ওপর গড়ে উঠা এই ওয়ার সিমেট্রির প্রবেশ পথের মূল ফটক থেকে সামান্য পথ হেঁটে গেলেই চোখে পড়ে লাল ইটের গাঁথুনির দুটি ছোট গির্জা ও মেটাল গেইট।
হাতের ডান পাশে গির্জায় একটি মেমোরিয়াল বুক রাখা আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতীয় বাণিজ্য তরীর প্রায় ছয় হাজার ৫০০ নাবিক ও লস্কর মারা যায়, যাদের লাশের হদিস মেলেনি কখনো। তাদের নাম ও পদবি এই মেমোরিয়াল বুকে সংরক্ষিত আছে।
হাতের বাঁ পাশের গির্জায় রয়েছে সিমেট্রি রেজিস্ট্রার, যাতে লেখা রয়েছে সমাহিত সেনা সদস্যদের নাম ও পদবী।তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিও সুন্দরভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। গেইট থেকেই সমাধিস্থলের মাঝ বরাবর একটি অপূর্ব ক্রুশ চিহ্নিত বেদি চোখে পড়ে। তার পরই পূর্বদিকে আছে একটি প্রার্থনা কক্ষ।
ওয়ার সিমেট্রির বাইরে খোলা মাঠ এবং সুন্দর বাগান আছে। মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে ওঠা এই সিমেট্রিতে চল্লিশ জাতের বৃক্ষরাজি রয়েছে। রয়েছে দেবদারু, গর্জন, মেহগনি, ইউক্যালিপটাস, পাম গাছ।
এছাড়া গন্ধরাজ, বেলী, পাতাবাহার, লেনথানা, গোলাপ, লেটারলিফসহ কয়েক শতাধিক দেশী-বিদেশী ফুল গাছ সমাধিতে এক অসাধারণ স্বর্গীয় মোহের সৃষ্টি করেছে। সমাধিস্থলে চোখে পড়বে অতি যতেœ সংরক্ষিত কবরের সারি। প্রতিটি কবরের গায়ে লেখা আছে শহীদদের নাম-পরিচয়। বিকেলে অনেক পর্যটক পাহাড়ের কোলে দাঁড়িয়ে সমাধি দেখতে আসেন।
কমনওয়েলথ ওয়ার সিমেট্রি চট্টগ্রামের দামপাড়া এলাকায়, ১৯নং বাদশা মিয়া সড়কে অবস্থিত। এটি চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে ২২ কিমি উত্তরে অবস্থিত। ওয়ার সিমেট্রির প্রতিষ্ঠাকালে এই এলাকাটি একটি বিশাল ধানের ক্ষেত ছিল, যদিও বর্তমানে এটি বেশ উন্নত এলাকা এবং শহরের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি প্রতিষ্ঠা করেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময় সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং ১৫২নং ব্রিটিশ জেনারেল হাসপাতালের সুবিধার কারণে চট্টগ্রামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্র বাহিনী চতুর্দশ সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প স্থাপন করেন। হাসপাতালটি ডিসেম্বর ১৯৪৪ থেকে অক্টোবর ১৯৪৫ পর্যন্ত সক্রিয় ছিলো।
সেই সময়ে এই ক্যাম্পে প্রচুর সৈন্যকে আহত অবস্থা থেকে সুস্থ করে দেশে পাঠানো হয়েছিল। আর যারা সেই জীবন যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল, তাদের সম্মানার্থে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর একটি দল এই সমাধিসৌধ প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রাথমিকভাবে এই সমাধিতে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রায় ৪০০ মৃতদেহ সমাহিত করা সম্ভব হয়েছিল। এছাড়াও যুদ্ধ শেষে অতিরিক্ত মৃতদেহ লুসাই, ঢাকা, খুলনা, যশোর, কক্সবাজার, ধোয়া পালং, দোহাজারি, রাঙ্গামাটি, পটিয়া এবং অন্যান্য অস্থায়ী সমাধিস্থান থেকে এই সমাধিস্থানে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে এখানে ৭৩১টি সমাধি বিদ্যমান, যার মধ্যে ১৭ জনের কোনো পরিচয় মেলেনি।
এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত জাতীয় বিদেশী সৈন্যদের মধ্যে (ওলন্দাজ এবং জাপানি সৈন্য) প্রায় ২০টি সমাধি বিদ্যমান। নাগরিকদের মধ্যে যুক্তরাজ্যের ৩৭৮ জন, কানাডার ২৫ জন, অস্ট্রেলিয়ার নয় জন, নিউজিল্যান্ডের দুই জন, অবিভক্ত ভারতের (বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান) ২১৪ জন, পূর্ব আফ্রিকার ১১ জন, পশ্চিম আফ্রিকার ৯০ জন, মিয়ানমারের দুই জন, নেদারল্যান্ডসের এক জন ও জাপানের ১৯ জন রয়েছেন।
পেশা অনুসারে এই সমাধিস্থলে সৈনিক ৫৪৩ জন, বৈমানিক ১৯৪ জন এবং নাবিক আছেন ১৪ জন। যুদ্ধকালীন সমাধি ছাড়াও বেসামরিক নাগরিকদের চারটি সমাধি এ কবরস্থানে রয়েছে। এছাড়া এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) চট্টগ্রাম-বোম্বের একটি স্মারক বিদ্যামান। পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে নির্মিত এ সিমেট্রির বাইরের অংশে খোলা মাঠ রয়েছে।
কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি কমিশনের বাংলাদেশের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই ওয়ার সেমেট্রিতে প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে দুপুর ১২টা এবং বিকেল তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্যে প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত থাকে যা শীতকালীন ও রোজার সময় কিছুটা পরিবর্তন ঘটে থাকে।