নিজস্ব প্রতিবেদক : উদীচী চট্টগ্রামের সভাপতি, শহীদজায়া মুশতারী শফী আর নেই(ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)। আজ সোমবার (২০ ডিসেম্বর-২১ইং) বিকেল চারটার দিকে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।
উদীচী চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক শীলা দাশগুপ্তা সুত্রে জানা গেছে, শহীদজায়া মুশতারী শফী লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। আজ সোমবার (২০ ডিসেম্বর-২১ইং) বিকেল চারটার দিকে তাঁর লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়। ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালে ২০ শে ডিসেম্বর বর্ণিল জীবন বেগম মুশতারী শফী।
উল্লেখ্য যে, শহীদ জায়া ও শহীদ ভগ্নি বেগম মুশতারী শফী একাধারে একজন সাহিত্যিক, সম্পাদক, বেতার ব্যক্তিত্ব, উদ্যোক্তা, নারী নেত্রী, সমাজ সংগঠক এবং সর্বোপরি সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি পিতার কর্মস্থল পশ্চিম বঙ্গে ভারতের মালদহ জেলার কালিয়াচক থানায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পৈতৃক নিবাস ফরিদপুরে ও নানাবাড়ি খুলনায়। জন্মের তিন মাস পর মা মারা যান। নয় বছর বয়সে বাবাও চলে যান না ফেরার দেশে।
দুই বোনের বিয়ের পর মুশতারী শফীকে পুরনো ঢাকার নারী শিক্ষা মন্দিরে ভর্তি করে দেয়া হয়।
১৯৫৩ সালের শেষের দিকে বিয়ে হয় ডা. শফির সঙ্গে। বিয়ের পর থেকেই তিনি চট্টগ্রামে বসবাস করছেন।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে সব সময়ই যুক্ত ছিলেন ডা. শফির পরিবার। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও পরিবারটির একটি ভূমিকা ছিল। বেতার কেন্দ্রর সূত্রপাত হয়েছিল ‘মুশতারী লজ’ নামের বাড়ি থেকেই।
ষাটের দশকের প্রথম ভাগে নারীমুক্তি আন্দোলনের লক্ষ্যে নিজ উদ্যোগে ‘বান্ধবী সংঘ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামে গড়ে তোলেন। সংঘের মুখপত্র ‘মাসিক বান্ধবী’ ১৯৬৪ সাল থেকে এক নাগাড়ে নিয়মিত ১১ বছর সম্পাদনা করেন। এমনকি চালু করেন নারী পরিচালিত ছাপাখানা, ‘মেয়েদের প্রেস’, যা আজকের দিনের বিবেচনাতেও ছিল একটি অত্যন্ত বৈপ্লবিক কাজ। কম্পোজ করা থেকে শুরু করে, মেশিন চালানো, বাঁধাই সব কাজই এক সময় ‘বান্ধবী’রাই করতে লাগলেন।
মেয়েদেরকে গান, গিটার, তবলা, সেলাই, এমনকি চামড়া কেটে ডাইস করে ব্যাগ তৈরি করাসহ নানা রকমের কুটির শিল্পের কাজ শেখানো হত ‘বান্ধবী’ সংগঠন থেকে। ‘বান্ধবী পুরস্কার’ও প্রবর্তন করা হয়েছিল। পর পর তিন বছর সেই পুরস্কার দেয়া হয়। দর্শণীর বিনিময়ে নাটকের আয়োজনও প্রথম করেছিল ‘বান্ধবী’। একাত্তরে বান্ধবী সংঘের পক্ষ থেকে তিন বার নারী সম্মেলন করা হয়। সেই সময় গ্রাম থেকে বোরখা পরে মহিলারা এসে সমাবেশে যোগ দিতেন।
মুশতারী শফীর বাড়ির নিচের গ্যারাজের জায়গাতে ছাপাখানা বসানো হয়েছিল। ৬৮, ৬৯ এ রাজনৈতিক পোস্টার, লিফলেট এসব ছাপানোর কাজ করা হয়।
১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলনে তিনি নিজেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালের শেষের দিকে। ‘৬৮, ‘৬৯’ এ রাজনৈতিক ঘন ঘটার সময় পোস্টার, লিফলেট এসব ছাপানোর ধুম পড়ে যায়। এ দিকে প্রেস চালাচ্ছেন, অন্য দিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডেও অংশ নেন। ১৯৭১ সালের মার্চ সংখ্যা বের করার পর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় পত্রিকা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুশতারী শফীর স্বামী ডা. মোহাম্মদ শফি ও তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছোট ভাই এহসান শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। যুদ্ধ শুরু হলে ২৭ শে মার্চ মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করার লক্ষ্যে ট্রাকভর্তি গোলাবারুদ নিজগৃহে ‘মুশতারী লজ’ এ গোপনে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করেন তিনি। এর পর যুদ্ধ চলাকালে তাঁর বাড়ি, বান্ধবীর অফিসসহ সবকিছু লুট হয়ে যায়। আগস্ট মাসে কলকাতায় গিয়ে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে’ শব্দ সৈনিক ও নাট্য শিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেন উম্মে কুলসুম নামে।
এছাড়াও আকাশ বাণীতে ডালিয়া মোহাম্মদ ছদ্ম নামে ‘জানেন ওদের মতলব কী?’ শিরোনামে স্বরচিত কথিকা ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছোট গল্প প্রচার শুরু করেন। তখনই পত্র-পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প।
দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রে ‘নিজস্ব লেখক শিল্পী’ পদে চাকুরীতে যোগদান করেন মুশতারী শফী। সামাজিক কর্মকান্ডের সঙ্গে চালিয়ে যান নিজের কর্মস্থলের কাজও। ১৯৯৫ সালে চিফ স্ক্রিপ্ট রাইটার পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এই সময় বেতারে প্রচারিত নাটকের সংখ্যা মোট ১৭ টি, যার মধ্যে মৌলিক রচনা নয়টি।
এছাড়াও বেতারে শিশু কিশোর অনুষ্ঠান, মহিলা বিষয়ক অনুষ্ঠান, কৃষি ভিত্তিক অনুষ্ঠান ও জনসংখ্যা কার্যক্রম অনুষ্ঠান বিভিন্ন মেয়াদে নিয়মিত পরিচালনা ও উপস্থাপনা করেন। পাশাপাশি বেতার নাটকে ও তিনি অংশগ্রহণ করেন।
তাঁর লেখার মধ্যে রয়েছে উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী, কিশোর গল্প গ্রন্থ, স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই। গল্প, উপন্যাস ছোটদের জন্য লিখলেও নিজের লেখালেখির মূল ক্ষেত্র হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকে বেছে নেন বেগম মুশতারী শফী। লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন’। গবেষণাধর্মী বই ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’, এছাড়া ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ ও ‘একুশের গল্প’ নামে আরো দুটো ছোট গল্পের সংকলন রয়েছে তাঁর।
‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’, ‘চিঠি জাহানারা ইমামকে’ এবং ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’ বইগুলোর উপজীব্য মুক্তিযুদ্ধ। শেষের বইটিতে তিনি একাত্তরে স্বামী ও ভাইকে হারানোর স্মৃতি তুলে ধরেছেন।
১৯৯২ সালে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ চট্টগ্রাম জেলা শাখার আহ্বায়ক হন মুশতারী শফী। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে চট্টগ্রাম জেলায় ঘাতক নির্মূল আন্দোলন বেগবান হয়। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কেন্দ্রের আহ্বায়ক পদ গ্রহণ করেন। এতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জাহানারা ইমামের মৃত্যুতে ঝিমিয়ে পড়া আন্দোলন পুনরায় গতি লাভ করে। এ সময় তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির এই আন্দোলনে প্রবাসী বাঙালিদের সম্পৃক্ত করার জন্য বিভিন্ন দেশ সফর করেন।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি নিয়ে পাকিস্তান পালার্মেন্টে ধৃষ্টতাপূর্ণ শোক প্রস্তাব পাশ করায় বাংলাদেশীদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন শহীদ জায়া বেগম মুশতারী শফী।
‘অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার-১৪২৪’ ভূষিত বেগম মুশতারী শফী সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে নারী জাগরণে অবদানের জন্য গত ৯ ডিসেম্বর ২০২০ রোকেয়া দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রবর্তিত ‘বেগম রোকেয়া পদক ২০২০’ পান।
সময়ের অগ্রপথিক, দূরদর্শী মুশতারী শফি সেই ষাট দশকের শুরুতেই মফস্বল চট্টগ্রামে নারীদের সংগঠন করেন। সেখান থেকেই তিনি চট্টগ্রাম উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি। এর মাঝে এতগুলো বছর সংগ্রাম, নেতৃত্ব, প্রতিবাদ সবকিছুতেই তাঁকে দেখা গিয়েছে। এমন একজন সংগ্রামী নারীর আদর্শ আমাদের ও আমাদের পরের প্রজন্মের পথ চলার জন্যে উপহার হয়ে থাকবে, আদর্শ হয়ে থাকবে।
‘নারী যোগাযোগ কেন্দ্র চট্টগ্রাম মহানগর’ ও ‘ইউনাইট থিয়েটার ফর সোশাল অ্যাকশন (উৎস)’ এই মহান ব্যক্তিকে গত শনিবার (১৯ ডিসেম্ব) সংবর্ধনা প্রদান করে।

নিজস্ব প্রতিবেদক : উদীচী চট্টগ্রামের সভাপতি, শহীদজায়া মুশতারী শফী আর নেই(ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন)। আজ সোমবার (২০ ডিসেম্বর-২১ইং) বিকেল চারটার দিকে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।
উদীচী চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক শীলা দাশগুপ্তা সুত্রে জানা গেছে, শহীদজায়া মুশতারী শফী লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। আজ সোমবার (২০ ডিসেম্বর-২১ইং) বিকেল চারটার দিকে তাঁর লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়। ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালে ২০ শে ডিসেম্বর বর্ণিল জীবন বেগম মুশতারী শফী।
উল্লেখ্য যে, শহীদ জায়া ও শহীদ ভগ্নি বেগম মুশতারী শফী একাধারে একজন সাহিত্যিক, সম্পাদক, বেতার ব্যক্তিত্ব, উদ্যোক্তা, নারী নেত্রী, সমাজ সংগঠক এবং সর্বোপরি সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি পিতার কর্মস্থল পশ্চিম বঙ্গে ভারতের মালদহ জেলার কালিয়াচক থানায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পৈতৃক নিবাস ফরিদপুরে ও নানাবাড়ি খুলনায়। জন্মের তিন মাস পর মা মারা যান। নয় বছর বয়সে বাবাও চলে যান না ফেরার দেশে।
দুই বোনের বিয়ের পর মুশতারী শফীকে পুরনো ঢাকার নারী শিক্ষা মন্দিরে ভর্তি করে দেয়া হয়।
১৯৫৩ সালের শেষের দিকে বিয়ে হয় ডা. শফির সঙ্গে। বিয়ের পর থেকেই তিনি চট্টগ্রামে বসবাস করছেন।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে সব সময়ই যুক্ত ছিলেন ডা. শফির পরিবার। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও পরিবারটির একটি ভূমিকা ছিল। বেতার কেন্দ্রর সূত্রপাত হয়েছিল ‘মুশতারী লজ’ নামের বাড়ি থেকেই।
ষাটের দশকের প্রথম ভাগে নারীমুক্তি আন্দোলনের লক্ষ্যে নিজ উদ্যোগে ‘বান্ধবী সংঘ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামে গড়ে তোলেন। সংঘের মুখপত্র ‘মাসিক বান্ধবী’ ১৯৬৪ সাল থেকে এক নাগাড়ে নিয়মিত ১১ বছর সম্পাদনা করেন। এমনকি চালু করেন নারী পরিচালিত ছাপাখানা, ‘মেয়েদের প্রেস’, যা আজকের দিনের বিবেচনাতেও ছিল একটি অত্যন্ত বৈপ্লবিক কাজ। কম্পোজ করা থেকে শুরু করে, মেশিন চালানো, বাঁধাই সব কাজই এক সময় ‘বান্ধবী’রাই করতে লাগলেন।
মেয়েদেরকে গান, গিটার, তবলা, সেলাই, এমনকি চামড়া কেটে ডাইস করে ব্যাগ তৈরি করাসহ নানা রকমের কুটির শিল্পের কাজ শেখানো হত ‘বান্ধবী’ সংগঠন থেকে। ‘বান্ধবী পুরস্কার’ও প্রবর্তন করা হয়েছিল। পর পর তিন বছর সেই পুরস্কার দেয়া হয়। দর্শণীর বিনিময়ে নাটকের আয়োজনও প্রথম করেছিল ‘বান্ধবী’। একাত্তরে বান্ধবী সংঘের পক্ষ থেকে তিন বার নারী সম্মেলন করা হয়। সেই সময় গ্রাম থেকে বোরখা পরে মহিলারা এসে সমাবেশে যোগ দিতেন।
মুশতারী শফীর বাড়ির নিচের গ্যারাজের জায়গাতে ছাপাখানা বসানো হয়েছিল। ৬৮, ৬৯ এ রাজনৈতিক পোস্টার, লিফলেট এসব ছাপানোর কাজ করা হয়।
১৯৬৯ সালের গণ আন্দোলনে তিনি নিজেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালের শেষের দিকে। ‘৬৮, ‘৬৯’ এ রাজনৈতিক ঘন ঘটার সময় পোস্টার, লিফলেট এসব ছাপানোর ধুম পড়ে যায়। এ দিকে প্রেস চালাচ্ছেন, অন্য দিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডেও অংশ নেন। ১৯৭১ সালের মার্চ সংখ্যা বের করার পর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় পত্রিকা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুশতারী শফীর স্বামী ডা. মোহাম্মদ শফি ও তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছোট ভাই এহসান শহীদ হন।
মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। যুদ্ধ শুরু হলে ২৭ শে মার্চ মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করার লক্ষ্যে ট্রাকভর্তি গোলাবারুদ নিজগৃহে ‘মুশতারী লজ’ এ গোপনে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করেন তিনি। এর পর যুদ্ধ চলাকালে তাঁর বাড়ি, বান্ধবীর অফিসসহ সবকিছু লুট হয়ে যায়। আগস্ট মাসে কলকাতায় গিয়ে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে’ শব্দ সৈনিক ও নাট্য শিল্পী হিসেবে কাজ শুরু করেন উম্মে কুলসুম নামে।
এছাড়াও আকাশ বাণীতে ডালিয়া মোহাম্মদ ছদ্ম নামে ‘জানেন ওদের মতলব কী?’ শিরোনামে স্বরচিত কথিকা ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছোট গল্প প্রচার শুরু করেন। তখনই পত্র-পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প।
দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রে ‘নিজস্ব লেখক শিল্পী’ পদে চাকুরীতে যোগদান করেন মুশতারী শফী। সামাজিক কর্মকান্ডের সঙ্গে চালিয়ে যান নিজের কর্মস্থলের কাজও। ১৯৯৫ সালে চিফ স্ক্রিপ্ট রাইটার পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এই সময় বেতারে প্রচারিত নাটকের সংখ্যা মোট ১৭ টি, যার মধ্যে মৌলিক রচনা নয়টি।
এছাড়াও বেতারে শিশু কিশোর অনুষ্ঠান, মহিলা বিষয়ক অনুষ্ঠান, কৃষি ভিত্তিক অনুষ্ঠান ও জনসংখ্যা কার্যক্রম অনুষ্ঠান বিভিন্ন মেয়াদে নিয়মিত পরিচালনা ও উপস্থাপনা করেন। পাশাপাশি বেতার নাটকে ও তিনি অংশগ্রহণ করেন।
তাঁর লেখার মধ্যে রয়েছে উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী, কিশোর গল্প গ্রন্থ, স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই। গল্প, উপন্যাস ছোটদের জন্য লিখলেও নিজের লেখালেখির মূল ক্ষেত্র হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকে বেছে নেন বেগম মুশতারী শফী। লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন’। গবেষণাধর্মী বই ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’, এছাড়া ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ ও ‘একুশের গল্প’ নামে আরো দুটো ছোট গল্পের সংকলন রয়েছে তাঁর।
‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’, ‘চিঠি জাহানারা ইমামকে’ এবং ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’ বইগুলোর উপজীব্য মুক্তিযুদ্ধ। শেষের বইটিতে তিনি একাত্তরে স্বামী ও ভাইকে হারানোর স্মৃতি তুলে ধরেছেন।
১৯৯২ সালে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ চট্টগ্রাম জেলা শাখার আহ্বায়ক হন মুশতারী শফী। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে চট্টগ্রাম জেলায় ঘাতক নির্মূল আন্দোলন বেগবান হয়। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কেন্দ্রের আহ্বায়ক পদ গ্রহণ করেন। এতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জাহানারা ইমামের মৃত্যুতে ঝিমিয়ে পড়া আন্দোলন পুনরায় গতি লাভ করে। এ সময় তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির এই আন্দোলনে প্রবাসী বাঙালিদের সম্পৃক্ত করার জন্য বিভিন্ন দেশ সফর করেন।
যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি নিয়ে পাকিস্তান পালার্মেন্টে ধৃষ্টতাপূর্ণ শোক প্রস্তাব পাশ করায় বাংলাদেশীদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন শহীদ জায়া বেগম মুশতারী শফী।
‘অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার-১৪২৪’ ভূষিত বেগম মুশতারী শফী সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে নারী জাগরণে অবদানের জন্য গত ৯ ডিসেম্বর ২০২০ রোকেয়া দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রবর্তিত ‘বেগম রোকেয়া পদক ২০২০’ পান।
সময়ের অগ্রপথিক, দূরদর্শী মুশতারী শফি সেই ষাট দশকের শুরুতেই মফস্বল চট্টগ্রামে নারীদের সংগঠন করেন। সেখান থেকেই তিনি চট্টগ্রাম উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি। এর মাঝে এতগুলো বছর সংগ্রাম, নেতৃত্ব, প্রতিবাদ সবকিছুতেই তাঁকে দেখা গিয়েছে। এমন একজন সংগ্রামী নারীর আদর্শ আমাদের ও আমাদের পরের প্রজন্মের পথ চলার জন্যে উপহার হয়ে থাকবে, আদর্শ হয়ে থাকবে।
‘নারী যোগাযোগ কেন্দ্র চট্টগ্রাম মহানগর’ ও ‘ইউনাইট থিয়েটার ফর সোশাল অ্যাকশন (উৎস)’ এই মহান ব্যক্তিকে গত শনিবার (১৯ ডিসেম্ব) সংবর্ধনা প্রদান করে।