দি ক্রাইম ডেস্ক: বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর জঙ্গিবাদ ও ধর্মীয় উগ্রবাদ নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বহু জঙ্গি সংশ্লিষ্ট আসামি জামিনে মুক্তি পেয়েছে-যাদের মধ্যে রয়েছে বিচারাধীন, সন্দেহভাজন এবং এমনকি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরাও।
কারা কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে অন্তত ৩০০ জনের বেশি জঙ্গি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জামিনে রয়েছেন। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে, বিশেষ করে সন্ত্রাসের শিকার পরিবারগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এই প্রেক্ষাপটে মালয়েশিয়ায় নিরাপত্তা বাহিনী ৩৬ জন বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করেছে, যাদের ‘উগ্র জঙ্গি আন্দোলনে’ জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। দেশটির গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ধারণা, গ্রেপ্তারকৃতদের কেউ কেউ বাংলাদেশে সরকার পতনের ষড়যন্ত্রে সম্পৃক্ত।
মালয়েশিয়ার পুলিশ প্রধান এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, গ্রেপ্তারকৃত একটি জঙ্গিগোষ্ঠী সিরিয়া ও বাংলাদেশে আইএস সেলগুলোকে অর্থ সহায়তা দিতে অর্থ সংগ্রহ করছিল। স্পেশাল ব্রাঞ্চের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের তদন্তে দেখা যায়, তারা সদস্য ফি ও দাতব্য অনুদানের মাধ্যমে তহবিল গড়ে তুলছিল।
স্থানীয় দৈনিক দ্য স্টার জানায়, এই গোষ্ঠীর নাম ‘গেরাকান মিলিটান র্যাডিক্যাল বাংলাদেশ (GRMB)’।ওয়াটসঅ্যাপ ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে তারা সদস্য সংগ্রহ করত এবং মতাদর্শ ছড়াত।
পাকিস্তানের গুজরানওয়ালায় লস্কর-ই-তৈয়বা নেতা মুজাম্মিল হাজমি দাবি করেছেন, ২০২৪ সালে শেখ হাসিনা সরকারের পতনে তাদের ভূমিকা ছিল। বিশ্লেষকদের মতে, এটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বহিরাগত ষড়যন্ত্রের প্রমাণ।
আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সাবেক প্রধান মুফতি জসীম উদ্দিন রাহমানী সম্প্রতি বলেন, “অনেকে নিরাপরাধ ছিলেন, কেউ ভুল করলে তওবা করেছেন।” বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের বক্তব্য উগ্রবাদকে বৈধতা দেওয়ার অপচেষ্টা।
২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান হামলায় ২০ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে ১৭ জনই বিদেশি। হামলার দায় আইএস স্বীকার করলেও বর্তমান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী এটিকে ‘জঙ্গি নাটক’ বলে অভিহিত করেন এবং দাবি করেন এটি ছিল আওয়ামী লীগের চক্রান্ত। এ ঘটনায় প্রতি বছর আয়োজিত শ্রদ্ধানুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ঘটনার স্থানে হিযবুত তাহরীরের পোস্টার দেখা গেছে, যা নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় জঙ্গি তৎপরতা, উগ্র ধর্মীয় চর্চা ও সাংস্কৃতিক নিধনের ঘটনা বেড়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগরীর জামালখানে একটি বামপন্থী কর্মসূচিতে এক নারীকে লাথি মারেন জামায়াতপন্থী এক ব্যক্তি। জামিনে মুক্তির পর তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়। একই ধরনের ঘটনা ঘটে ঢাবিতেও।
সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি লালমনিরহাটে দুই হিন্দু নরসুন্দরকে ইসলাম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে হেনস্তা করা হয়, যদিও পরিবার জানায়, এটি ছিল একটি আর্থিক বিরোধ।
কাশিমপুর কারাগার থেকে ২০৯ জন জঙ্গি বন্দি পালিয়ে গেছেন এবং এর আগেও নরসিংদীতে সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে।
হিযবুত তাহরীরের প্রকাশ্য মার্চ: ঢাকায় তারা ‘খেলাফত মার্চ’ করে, যা আগাম তথ্য থাকা সত্ত্বেও পুলিশ থামাতে ব্যর্থ হয়।
সংস্কৃতি, উৎসব ও খেলাধুলার উপর হামলাঃ গত তিন মাসে ১০৫টির বেশি সুফি মাজারে হামলা হয়েছে। হামলা হয়েছে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর, জয়নুল গ্যালারির ভাস্কর্য, রবীন্দ্রনাথের কাচারি বাড়ি এবং সিরাজগঞ্জের শশী লজের ‘ভেনাস’ মূর্তিতে। নারীদের ফুটবল ম্যাচ, বসন্ত উৎসবে হামলা প্রমাণ করে উগ্রবাদ এখন সংস্কৃতি ও খেলাধুলার প্রতিও হুমকি হয়ে উঠেছে।
সরকারি প্রতিক্রিয়া ও বিতর্কঃ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও তথ্যমন্ত্রী মাহফুজ আলম দাবি করেন, “দেশে কোনো জঙ্গি উত্থান ঘটেনি” এবং “চরমপন্থার সুযোগ দেওয়া হবে না।” কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাস্তবতা এই দাবির সঙ্গে মেলে না।
অস্ত্রধারীদের সক্রিয়তা ও প্রশাসনের ভূমিকাঃ সম্প্রতি বিমানবন্দরে উপদেষ্টার ব্যাগে একে-৪৭ রাইফেলের গুলি পাওয়া যায়। তার সঙ্গে হিযবুত তাহরীর ও শিবিরের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন জানান, ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ, যিনি আগে হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাকে নিয়োগ দেন ইউনূস সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ।
জুলাই মাসজুড়ে এসব ঘটনা বাংলাদেশের জন্য বড় সতর্কবার্তা। বিশ্লেষকরা বলছেন, সময় থাকতে রাজনৈতিক দল, প্রশাসন ও নাগরিক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই উগ্রবাদী স্রোতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। নচেত, দেশ দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ও সাংস্কৃতিক সংকটে পড়বে-যার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।